আল-কোরআনের অজানা রহস্য – ২

সময়: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২:৫৮ অপরাহ্ণ

লেখক:

উৎস: ফেসবুক ওয়াল থেকে

টপিক: , , , ,

ট্যাগ: 

লেখক প্রোফাইল 

বড় করুন

ছোট করুন

সূরা বাকারায় গরুর রহস্য কী?

শাকিল জানতে চাইল – গুরুজী, সুরা বাকারার গরুর পরিচয় না পেয়েই কোরান পড়ে চলেছি। নামাজ-রোজায় মুসলমান আছি তাতে সন্দেহ নেই। তবে সত্যি বলতে কি, কোরান পড়তে শিখি নি। ইসলামের পথ জান্নাতের পথ। সেই বিশ্বাস রাখি বলেই বেচে আছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, জীবনে কখনও মনে হয় নি যে কোরান পড়তে শিখেছি। কেউ যখন আরবি জানার জোরে কোরান পড়তে পেরেছে বলে দাবি করে তখন শুধু এই আশ্বাস টুকু পাই যে তার কাছ থেকে ধর্মের নিয়ম-কানুন টা অন্তত জানতে পারব। তবে তার বেশি নয়। কোরানের প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া অন্তর সন্তুষ্ট হয় না। মনে হয় শুধু জান্নাতের লোভে বস্তুবাদী আচরণ করছি। আর এ কারণেই আপনার কাছে কিছু কিছু জানতে চাই। এই বিশ্বাস নিয়ে আসি যে অন্তত কিছু হলেও পাবো।
গুরুজী বললেন – বরাবরের মতো এই কথাটা আবার ও বলে নিচ্ছি যে আমি মনে করি না যে আমি কোরান জ্ঞান অর্জন যোগ্যতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমার কাছে তোমরা আস দেখে পরম শ্রদ্ধাভরে আমি আমার মনের মধ্যে দুটো চোখ ডূবিয়ে দেই। এবং সাহস করে কিছু বলি। তাই আমার জ্ঞানকে কখনই চূড়ান্ত মনে করো না।
নিশ্চয়ই এই কথাটি মনে আছে যে হযরত মূসা যখন তার গোত্রের লোকেদেরকে ফেরাউনের কবল থেকে সমুদ্র পার করে নিরাপদে নিয়ে গেলেন তখন তিনি তাদেরকে পাহাড়ের উপত্যকায় অপেক্ষায় রেখে মহান আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার জন্য পাহাড়ের ভিতর প্রবেশ করলেন। আল্লাহর সঙ্গে তার যখন দেখা হলো তখন আল্লাহ নিজেই মুসা (আ) কে এই সংবাদ দিলেন যে তিনি তার অবর্তমানে তার গোত্রের লোকেদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছেন। হযরত মুসা (আ) আল্লাহর সঙ্গে যাবতীয় আলাপ শেষে তার গোত্রের লোকেদের কাছে ফিরে এসে দেখলেন যে তারা একটি গরুর বাছুরের পূজা করতে শুরু করেছে। এই গরু যে তৈরি করেছিল তার নাম সামেরি। এই জঘন্য কাজটি সে কেন করলো তা জানতে চাইলে সামেরি বলল যে সে জিব্রিল (আ) কে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছিল এবং তার মনে এই ইচ্ছে জেগেছিল যে সে ওই ফেরেস্তা পায়ের নিচে ধুলো দিয়ে একটা গরুর বাছুর বানাবে। এবং সে তাই করেছিল।
একটা বিশেষ বিষয় লক্ষ্য করো। অন্য যে কোনো মাটি দিয়ে যদি তা গরুর বাছুরের মূর্তি বানানো হতো তাহলে তা থেকে গরুর ডাকের মতো শব্দ বের হতো না। কিন্তু জিব্রিলের (আ) পায়ের নিচের ধুলো থেকে বানানো হয়েছিল বলে এই মহাজ্ঞানী ফেরেস্তার উপস্থিতির চৌম্বকত্বের কারণে সেই সোনার পুতুল কিছুটা প্রাণীর মতো আচরণ করেছিল। তবে সামান্য শব্দ করা পর্যন্তই ছিল তার দৌড়।
এ থেকে আমরা একটি বিষয় আরো একবার আবিষ্কার করতে পারি। তা হল এই যে বাণী সৃষ্টি করা জিব্রিলের কাজ নয়। বরং তিনি বাণীর বাহক মাত্র। অন্য কথায়, তিনি রাসুল(সা) কে তার নিজের বাণী দিয়ে যাননি, বরং তার কাছে আল্লাহ বাণী বই নিয়ে এসেছেন।
বিষয়টি আরো সুন্দরভাবে বুঝতে সাহায্য করার জন্য একটি উপমা দেই। কল্পনা কর যে জিব্রিল (আ) হলেন সেই বিস্ময়কর কষ্ঠি পাথরের মত শক্তি, যার উপস্থিতিতে কোনো বস্তুর মধ্যে লুকানো অন্তর্নিহিত ভাষা প্রকাশ পায়। এটি একটি কল্পনা মাত্র। এভাবে যদি বিষয়টিকে ধরে নেয়া যায় তাহলে কোনো মাটির পুতুলের কাছে তাকে নিলে তা যে প্রাণীর দেহের আদলে সৃষ্ট, তার থেকে সেই প্রাণীর ধ্বনি বের হবে। তাকে যদি কো্নো কবির হৃদয়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে তার উপস্থিতির কারণে সেই হৃদয় থেকে কাব্য নির্গত হবে। রাসূল কিন্তু বলেই দিয়েছেন যে একজন বিশ্বাসী এবং মৌলিক কবি নবুয়াতের ৪৬ ভাগের এক ভাগ পেয়েছেন।জ্ঞান পাওয়া আর নবুয়তির এক ভাগ পাওয়া এক কথা নয়। জ্ঞানীর চেয়ে এভাবে ভিতর-থেকে-উপলব্ধি পাওয়া ব্যক্তির মূল্য লক্ষ কোটি গুণ বেশি।
তিনি যদি কোন রসুলের অন্তরের কাছে যান, তাহলে সেই রসূলের অন্তরে লাওহে মাহফুজে লিখিত আল্লার বাণীর উদয় ঘটবে এটাই স্বাভাবিক।
যা হোক, আমরা যদি ধরে নি্তাম যে জিব্রিল রসুলের (সা) কাছে আলাদা করে কোনো বাণী আনেন নি, তা হলেও কিন্তু আমরা এত দূর পর্যন্ত আশা করতে পারতাম। কিন্তু মূলত আল্লাহর আদেশে পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী তিনি লাওহে মাহফুজ থেকে আল্লাহর বাণী নিয়ে এসেছেন। আমরা কথাটি এই জন্য বললাম যে জিব্রিলের (আ) উপস্থিতি বাণীময় ছাড়া ছাড়া আর কিছু নয়। তার উপস্থিতির কারণেই কিন্তু আল্লাহর আদেশে মা মরিয়মের গর্ভে হযরত ঈসার (আ) জন্ম হয়েছিল। এ কারণে শিশুকাল থেকেই তিনি কথা বলতে পারতেন।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও, ইঙ্গিত চলে আসার কারণে আর একটি কথা না বলে পারছি না। বড় বড় জ্ঞানী এবং ইবাদতকারী পবিত্র ব্যক্তিগণ নবী-রসূলগণের যোগ্য উত্তরসূরী। অথচ এই জাতীয় জান্নাতি ব্যক্তিদের কেও আল্লাহ নবুয়াতির ৪৬ ভাগের একভাগ প্রাপ্তির সুসংবাদ দেন নি, যদি তারা ইলহাম বা ভিতর থেকে উঠে আসা পবিত্র কবিত্ব না পেয়ে থাকেন। কবিত্বের মর্যাদা এতটা উঁচুতে এ কারণে যে তার বাণী আসে ভেতর থেকে। অপরপক্ষে আমরা যারা তথাকথিত জ্ঞানী, তাদের বাণী সত্য হলেও তা আসে বাইরে থেকে, তথা বিদ্যা চর্চা থেকে। আর এ কারণেই মর্যাদার এই বিশাল ব্যবধান। ইবাদতকারী এবং আত্মজ্ঞানী এই দুইয়ের মধ্যেও মর্যাদার বিশাল ব্যবধান। রসুল নিজে এই ঘোষণা দিয়েছেন যে তার সঙ্গে সাহাবাদের যে ব্যবধান, আরেফ এর সঙ্গে আবেদ এর সেই ব্যবধান। উল্লেখ্য যে, কিছু নামধারী আলেম অনেক উচু পর্যায়ের আরেকজনকে নিয়ে কু-মন্তব্য করে তাদেরকে ছোট করে দেখাতে চায়।এই আচরণের পরিণতি নিশ্চিত ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়।
যা হোক, কারো চিন্তা যদি সত্যমুখী না হয়ে শক্তিমুখী হয়, তাহলে ব্যক্তি উপাসনার প্রয়োজন বোধ করে বটে, তবে সঠিক উপাস্য কে বেছে না নিয়ে নিজের মনগড়া একটি উপাস্য সৃষ্টি করে, কারণ শক্তির উৎসের উপর তার দখল প্রয়োজন
এই সুযোগে এই ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। ইহুদি জাতির মতো তাদের মহিলারা অত্যন্ত লোভী। তারা যখন মিশর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল, তার আগে অর্থাৎ পালাবার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর, যার যার প্রতিবেশী মহিলাদের কাছ থেকে অনেক স্বর্ণালংকার নিয়েছি্‌ এই অজুহাতে যে তারা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের যোগদান করতে যাবে এবং সেখানে তাদের অলংকারের প্রয়োজন হব্‌ এবং ফিরে এসে যার যার অলংকার তাদেরকে ফেরত দেবে।
সামেরি ছিল একজন কর্মকার। ইহুদি মহিলাদের এই স্বর্ণালংকারের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে সে জানতো এবং তাই তাদের কাছ থেকে তা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সে আগুনের মাধ্যমে মহিলাদের কাছ থেকে নেয়া যাবতীয় স্বর্ণালংকার গলিয়ে একটি মাত্র পিণ্ডতে রূপান্তরিত করেছিল। তারপর তা দিয়েছে একটি গরুর বাছুরের আকৃতি তৈরি করল। সে এই কাজে মিশরের মূর্তির অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছিল । প্রচলিত একটি দেবতা তৈরি করতে চেয়েছিল হয়তো।
যা হোক, হযরত জিব্রিল (আ) যখন সেই পথ দিয়ে চলাচল করেছিলেন তখন কেউ তা দেখতে না পেলেও সামেরি তা দেখতে পেয়েছিল। আর মনে এই ভাবনা উদিত হয়েছিল যে সে যদি এই মহান ফেরেশতার পায়ের নিচের কিছু ধুলো নিয়ে সেই স্বর্ণপিণ্ডের ওপর নিক্ষেপ করে তাহলে সেই মূর্তিটি হয়তো কথা বলবে বা কোনো না কো্নো ভাবে প্রাণীর মতো আচরণ করবে। এবং বিস্ময়কর ভাবে তার ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এই মহান ফেরেশতার পায়ের ধুলোর স্পর্শের কারণে সেই বাছুরের মূর্তিটি শব্দ করতে থাকলো।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। হযরত জিব্রিল (আ) হলেন মহান আল্লাহ তা’আলার প্রকাশিত জ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ আধার। সেই জ্ঞান যা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত। যেহেতু ফেরেশতাগণের নিজস্ব ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কোনোটাই নেই যেহেতু তাদের বাহ্যিক স্পর্শ তাদের ভিতরে যা রয়েছে তারই চুম্বকত্বের আবেশ সৃষ্টি করবে। হযরত জিবরীল হলেন ভাষা ও বাণীর পূর্ণাঙ্গ ধারক এবং বিশ্বস্ত বাহক। নিজে ইচ্ছা ও অনিচ্ছা শক্তি বিহীন ধারক হওয়ার কারণে তিনি নিজেই জ্ঞানময় এবং বাণীময়। আর এ কারণেই তার স্পর্শের আশীর্বাদ পুষ্ট ধুলো নিজেই বাণীময় হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এখানেই শুরু হবে মূল রহস্য। জিব্রিল নিজে বাণী, কিন্তু নিজে জ্ঞানের উৎস নন। জ্ঞান ছাড়া বাণীর মাধ্যমে কিছুই প্রকাশিত হয় না। এ কারণে সেই মূর্তি কেবল তার আকৃতির সাথে খাপ খায় এমন শব্দ করতে পেরেছিল, কিন্তু কথা বলতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট আয়াতে আল্লাহ এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
অতঃপর সে তাদের জন্য তৈরী করে বের করল একটি গো-বৎস, একটা দেহ, যার মধ্যে গরুর শব্দ ছিল। তারা বললঃ এটা তোমাদের উপাস্য এবং মূসার ও উপাস্য, অতঃপর মূসা ভুলে গেছে।
তারা কি দেখে না যে, এটা তাদের কোন কথার উত্তর দেয় না এবং তারে কোন ক্ষতি ও উপকার করার ক্ষমতাও রাখে না? [সুরা ত্ব হা ৮৮-৮৯]
সামেরি যা উপলব্ধি করেছিল তা ছিল বিশ্বাসভিত্তিক। কিন্তু আমাদেরকে প্রকৃত রহস্য জানতে হলে আমাদের চিন্তাকে হতে হবে জ্ঞানভিত্তিক এবং কুরআনের আয়াত অনুযায়ী বিশ্লেষণ-ভিত্তিক। হযরত জিব্রিলের (আ) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার একটি ধারণা ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর জ্ঞান এবং বাণীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। সে বুঝতে পারেনি যে জ্ঞান এবং বাণী আল্লাহরই বৈশিষ্ট্য । ফলে আল্লাহর জ্ঞান তাঁর বাণীর মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। হযরত জিব্রিল (আ) হলেন শুধু বাণীর ধারক ও বাহক। ফলে তাঁর স্পর্শে যার মধ্যে যতটুকু বাণীর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে তার মধ্যে থেকে কেবল ততটুকুই প্রকাশিত হবে। তাই স্বর্ণ নির্মিত সেই বাছুর টি কথা বলতে পারেনি, যদিও সামেরি এটাই আশা করেছিল।
আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান এবং ভাষা উভয় যদি কোনো সত্তাকে একই সাথে দেয়া হয় তাহলে তা জ্ঞানময় ভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে কথা বলবে এবং ভাব বিনিময় করবে, যেমনটি করেছিলেন শিশু ঈসা।
আয়াতুল কুরসি তে আল্লাহ বলেছেন যে তার ইচ্ছা এবং অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর জ্ঞান থেকে কিছুই লাভ করতে পারে না। সুতরাং বাক্যের সান্নিধ্য যতই লাভ করা হোক না কেন, আল্লার জ্ঞানের সান্নিধ্য ছাড়া কোনো কিছুর মুখে কোন চলমান ভাষা বুঝবে না। তবে আর সান্নিধ্য অবশ্যই ভাষার জড়তা দূর করে দেবে, যেমনটি হয়েছিল রাসুলের (সা) ক্ষেত্রে। হযরত জিবরীল (আ) রসূল(সা) কে বুকে চাপ দেয়ার কারণে প্রকাশিত আল্লাহর জ্ঞান তার হৃদয়ে প্রবেশের পথে যাবতীয় বাধা দূর হয়ে গেল।
যা হোক, আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। ইহুদী মহিলাদের লালসার হাত দ্বারা সংগ্রহকৃত সোনা এবং পাপীষ্ঠ সামেরির পথভ্রষ্ট পরিকল্পনা দ্বারা তৈরি কৃত সোনার বাছুর গোটা ইহুদি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার উপাসনার প্রতীক। ফলে এই স্বর্ণের গরুর পূজা হলো আশা-আকাঙ্ক্ষা তথা নফসের পূজা। আমরা বিশ্বজুড়ে তাকিয়ে দেখতে পাই যে ইহুদিরা সত্যিকার অর্থেই আশা-আকাঙ্ক্ষার পূজারী।
আল-কোরআনের সূরা বাকারায় দ্বিতীয়বার গরুর উল্লেখ এসেছে পূজা প্রসঙ্গে নয়, বরং কোরবানি প্রসঙ্গে। আল্লাহ হযরত মুসার (আ) মাধ্যমে ইহুদিদের জাতিকে একটি গরু কোরবানি করতে বলেছিলেন। আল্লাহর আদেশ মূসা (আ) এর মাধ্যমে শোনা মাত্রই ইহুদিরা বললো – তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো?
প্রিয় শিক্ষার্থী! একটু গভীরভাবে চিন্তা করো। এমন এক রহস্য জানতে পারবে যা আজও পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো পণ্ডিত তোমাকে জানায় নি। কোরবানি সব ধর্মের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু হযরত মূসা (আ) যখন তার গোত্রকে কোরবানি করার কথা বলবেন তখন তাদের কাছে এই প্রস্তাব কেন ঠাট্টা বলে মনে হয়েছিল?
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে কোরআনের এই বাণী কোনো জিন বা মানবের সৃষ্টি হতে পারে না। কোরবানির প্রসঙ্গটিকে আদৌ ঠাট্টার বিষয় হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। আমরা জানি যে হিন্দু ধর্মে কোরবানির রয়েছে। খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মে কোরবানির যাবতীয় ঘটনা রয়েছে। তাদের ধর্মে এই কাহিনী রয়েছে যে হযরত ইব্রাহিম (আ) তার সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিলেন। তাদের ধর্মে মানবজাতির প্রথম কোরবানির কাহিনী বাস্তব ভাবে রয়েছে। কাবিলের কোরবানি গ্রহণ করা হয়নি বলেই তো সে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল।
তাহলে কোরবানির প্রসঙ্গ এলে ইহুদিরা কেন বিষয়টিকে ঠাট্টার বিষয়ে হিসেবে ভেবে নিল?
হযরত মুসা (আ) যখন তার গোত্রের লোকজনকে একটি গরু কোরবানি করতে বলল তখন সেই সোনার গরুর কথা তাদের মনে পড়ে গিয়েছিল। তারা ভেবেছিল যে তাদের সেই সোনার গরু পূজার প্রতিশোধ হিসেবে বাস্তব গরু কোরবানির কথা বলা হয়েছে। পুরনো সেই অপরাধের কথা মনে পড়ার কারণে মুসার (আ) কথায় তাদের আঁতে ঘা লাগলো। তাদের কাছে মনে হয়েছিল যে মুসা (আ) সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিইয়ে তাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
প্রকৃতপক্ষে তাদের ধারণাও সঠিক ছিল। তাদের অন্তরকে আহত করার উদ্দেশ্যে নয়, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষার পূজার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অন্তরকে বিশুদ্ধ করার উপায় হিসেবে হযরত মুসা (আ) তাদেরকে গরু কোরবানি করতে বলেছিলেন। চোরের মন পুলিশ পুলিশ স্বভাবে আঘাত লাগার কারণে তাদের মধ্যে ঠাট্টার প্রসঙ্গটি এসেছিল বটে, এবং এই গরু কোরবানির মাধ্যমে তাদের গরু পূজা প্রবণতার একটা সমাধান অনুসন্ধানের লক্ষ্য ছিল তা সত্য হওয়া সত্ত্বেও, এমনটি নয় যে তারা সেই গরুর পূজা এবং এই গরু কোরবানির মধ্যকার আধ্যাত্মিক যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পেরেছিল। ইহুদী জাতির অধিকাংশই ধ্যাত্মিকভাবে অন্ধ জাতি। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে তাদের অন্তর পাথরের চেয়েও কঠিন। আর এই জাতীয় অন্তরের জন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং উপলব্ধি অনুসন্ধানের কোনো সুযোগই নেই।
হযরত মুসা (আ) গুরুত্বের সাথে কথা বলছেন দেখে তারা বিশ্বাস করল যে আল্লাহ সত্যি চাচ্ছেন যে তারা একটি গরু কোরবানি করুক। তখন তারা হযরত মুসার (আ) কাছে সেই গরুর বর্ণনা জানতে চাইলো। হযরত মুসা গরুটি বর্ণনা করতে গিয়ে যা বললেন তার মধ্যে প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই যে তার রং হবে উজ্জ্বল হলুদ যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অনুধাবনযোগ্য। হলুদ রঙের গরু সচরাচর দেখা যায় না। বরং যে ধরনের গরুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা দেখাই যায় না। ফলে এরূপ গরুর সন্ধান কেউ পেলে তা কখনোই কুরবানী করতে কারো মন চাইবে না। এবং তাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এরূপ একটি গরুর সন্ধান তারা ঠিকই পেয়েছিল কিন্তু তাদের মন সেটিকে কোরবানি করতে চাইনি।
যা হোক, অবশেষে তারা সেই গরুটিকে কোরবানি করলো।
সেই সেই কোরবানি করা মাংসের এক টুকরোর আঘাতে নিহত হয়েছে এমন মৃতদেহের স্পর্শ করার সাথে সাথে সে প্রাণ ফিরে পেল।
এই ঘটনাটি কিন্তু স্বাভাবিক চিন্তা যুক্তি এবং প্রাকৃতিক ভাবনার মধ্যে ফেলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ কারণে আমাদেরকে এই বিষয়টিকে, তা বাস্তব ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও, পাশাপাশি একটি আধ্যাত্মিক এবং বাস্তব ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
এর আগে সোনার তৈরি মূর্তি টি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সোনা দিয়ে তৈরি একটি গরুর বাছুর একটি গরুর মূর্তি হয়েই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা দান করেছে হযরত জীবরীলের (আ) পায়ের নিচের মাটি। আর এ কারণে এই ঘটনাটি একটি প্রতীকী ঘটনায়ও রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেই প্রতীক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা ভাষা এবং জ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ভাষা ও জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কিছু ধারনা লাভ করেছি।
এখন কোরবানি করা এই গরুটির প্রসঙ্গেও আমরা অন্তর্নিহিত রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করব। প্রথমত গরুটির রং এর তথ্য আমাদেরকে এই ধারণা দিচ্ছে যে এই কোরবানি কোনো সাধারণ কোরবানি নয়। মানুষ যে গরু কোরবানি করে তা একটি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু যাবতীয় শর্ত পূরণ করার মাধ্যমে এই যে কোরবানি সংঘটিত হয়েছে তা কোনো সাধারণ কোরবানি নয়। এবং এই কোরবানির অন্তরালে প্রাণশক্তি জেগে ওঠার যে একটি সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল তাও আমাদেরকে একই সিদ্ধান্ত প্রদান করছে।
সোনা দিয়ে তৈরি গরুর মূর্তির কোনো শব্দ করার কথা নয়। তবুও তার মধ্যে হজরত জিব্রীলের (আ) পায়ের নিচের ধুলোর উপস্থিতি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কিছু প্রাণের উপসর্গ সৃষ্টি করেছিল। সাত পাঁচ না ভেবে এই সামান্য প্রাণের উপস্থিতি দেখে ইহুদিরা মূর্তিটিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি। চিন্তার এবং উপলব্ধির গভীরতা না থাকলে যা ঘটে তাদের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল।
আল্লাহ এই গরু কোরবানির মাধ্যমে তাদেরকে সেই বিষয়টি দেখিয়ে দিলেন যা নিয়ে তারা ভাবেনি। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করার প্রাণশক্তি আর সোনার মূর্তির মধ্যে কিছু শব্দ সৃষ্টি করার তাৎক্ষণিক কম্পন এক জিনিস নয়।
চিত্রকরের দৃষ্টিতেও হলুদ গরু প্রতীকের মর্যাদা পেয়েছে। জার্মান চিত্রকর Franz Marc তার ইয়েলো কাউ বা গেইবে খু চিত্রক্ররমকে প্রাণ শক্তি এবং নারীত্বের প্রতীক হিসেবেই তুলে ধরেছেন। এটি একটি অদ্ভুত বিষয়। সৃষ্টি রহস্যের সবকিছুই মানুষের স্বভাবে কোনো না কোনো ভাবে প্রতিফলিত হয়। এ কারণে আর্টিস্টের কল্পনায়ও কিছু না কিছু ধরা পড়ে। আল্লাহ নিজেই বলেছেন যে তিনি আমাদের কে তাঁর নিজের স্বভাব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন (৩০ঃ৩০)। এই কারণে এই জাতীয় ঘটনা ঘটে।
এখন আমরা আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরবানী করা এই গরুটির দিকে তাকাই। এই সুন্দর গরুটি হলো মানুষের মন বা নফস। মানুষ যদি তার মনটিকে সঠিকভাবে কোরবানি করার মাধ্যমে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে তাহলে সে যেমন নিজে প্রকৃত প্রাণ ফিরে পায় তেমনি অন্যদের প্রাণ ফিরে পাওয়ার কারণ হয়।
স্রষ্টার সাথে মনে মননে ও কাজে সঠিক সম্পর্ক রাখতে হলে নিজের আশা-আকাংক্ষার অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয় বা কুরবানী করতে হয়। আর এভাবে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক সঠিক হয়ে গেলে তাকেই বলে প্রকৃত বেঁচে থাকা। কথাগুলিকে প্রতীকী কথা বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু কথাগুলি একেবারেই বাস্তব। আল্লাহ কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রেও এই কথাটি বলেছেন যে সঠিকভাবে নামাজ আদায় করলে তিনি আমাদেরকে যেভাবে সৃষ্টি করেছিলেন ঠিক সেভাবেই আমাদের পুনরুত্থান ঘটাবেন।
তোমরা প্রত্যেক সেজদার সময় স্বীয় মুখমন্ডল সোজা রাখ এবং তাঁকে খাঁটি আনুগত্যশীল হয়ে ডাক। তোমাদেরকে প্রথমে যেমন সৃষ্টি করেছেন, পুনর্বারও সৃজিত হবে। [৭ঃ২৯]
বস্তুগত পুনরুত্থানের কথার প্রসঙ্গের সাথে সাথে এখানে আধ্যাত্মিক পুনরুত্থানের ইঙ্গিতও বুঝতে হবে। কারণ সঠিক ভাবে নামাজ আদায় করলে আমরা নিষ্পাপ হয়ে যাই এবং আমাদের অন্তর শিশুর মতো পবিত্র হয়ে যায়। অর্থাৎ অন্তর আগের নিষ্পাপ অবস্থায় ফিরে যায়। আর এ কারণে আমি প্রায়ই এই কথাটি বলে থাকি যে, যার নামাজ তার অতীতকে ফিরিয়ে দেয় নি, সেই নামাজ দিয়ে সে কী ভবিষ্যৎ ই বা কামনা করতে পারে?
অর্থাৎ দেখা গেল যে সোনা দিয়ে যে মূর্তি বানানো হয়েছিল তা ছিল মানুষের জাগতিক লোভ লালসা ও যাবতীয় কামনা-বাসনার প্রতীক। এবং জাগতিক কামনা বাসনার এই প্রাণরূপী অদৃশ্য দেহটা হলো মানুষের মন বা নফস। এটাই সেই হলুদ রঙের গরু
কেবল গরুই গরুর পুজো করে থাকে। মানুষ কখনো গরুর পূজা করবে না। বরং মানুষ গরু কোরবানি করবে। আর এভাবে আশা আকাঙ্ক্ষা রূপ গরুকে কোরবানি বা ত্যাগ করার মাধ্যমে মানুষ তার প্রকৃত প্রাণ শক্তিটুকু কে জীবনের নির্যাস হিসেবে নিয়ে নেবে।
কিন্তু ইহুদিরা গরু পুজো করেছিল। আমরা বলেছি যে একমাত্র গরুই গরুর পুজো করে। বরং আল্লাহ তাদেরকে তার চেয়েও খারাপ নামে অভিহিত করেছেন। গরু তো চতুষ্পদ প্রাণী। আল্লাহ তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন।

মন্তব্য লিখুন

একই বিভাগে আরও

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১

ভালোবাসার শানে নুজুল

আরও পড়ুন

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

ফেব্রুয়ারি ২৭ ২০২৪

Instant Writing Techniques 1

ফেব্রুয়ারি ১৫ ২০২৪

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১