সময়ের অজানা রহস্যঃ বিজ্ঞানের ওপারে – ৩

বড় করুন

ছোট করুন

সোহাগ বলল – গুরুজী, আপনার কাছ থেকে ম্যাজিক দেখতে চাই।

গুরুজি বললেন – সুসংবাদের বিষয় হলো, আজ আমার কাছে আমার ম্যাজিক বাক্স টা আছে। বনে জঙ্গলে মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখা ভালো। মনটা ভালো থাকে। মোটের ওপর, ম্যাজিক তো হাতের ছলাকলা ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে এসো, ওই গাছ থেকে একটা কাঁচা ফল পেড়ে নিয়ে আসো।

বুড্ডা দৌড়ে গিয়ে নির্ধারিত গাছটি থেকে একটি ফল পেড়ে আনলো। তারপর গুরুজি একটা সবজি গাছ থেকে কিছু পাতা আনতে বললেন। সোহাগ দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি পাতা নিয়ে এলো।

এবার গুরুজী তার ঝুলি থেকে একটি ডিম বের করলেন – একটা মশা বা মাছি হলে ভালো হতো।

বুড্ডা বলল – মশা ধরা সম্ভব নয়, যদিও মেরে ফেলা যাবে। মাছি তো একেবারেই ধরা সম্ভব নয়।

কিন্তু সোহাগ অদূরে এক ধরনের পোকা দেখতে পেয়ে তা ধরে আনল।

বুড্ডা জানতে চাইল – গুরুজী, আমরা কি প্রাকৃতিক জাদু দেখতে যাচ্ছি?

সোহাগ বলল – আপনি জ্ঞানের রাজ্যে যাদুকর তা জানতাম। কিন্তু হাতের কলাকৌশল জানেন, তা কিন্তু জানতাম না।

গুরুজি বললেন – চাক্ষুষ ভাবে বিস্ময় সৃষ্টি করে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কিছু কৌশল শিখে নিয়েছিলাম। তোমাদের সামনে দেখানো হয়নি। তবে অন্য অনেক শিক্ষার্থীকে জাদুর মাধ্যমেও অনেক বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছি।

কথা বলতে বলতে গুরুজি প্রথমে ফলটিকে একটি কাঁচের পাত্রের মধ্যে ছেড়ে দিলেন। বাইরে থেকে ফলটিকে দেখা যাচ্ছে। গুরুজি প্রশ্ন করলেন – আমাকে বল তো, এই ফলের মধ্যে কী কী উপাদান রয়েছে?

বুড্ডা বলল – গুরুজী, তথ্যগুলি সঠিকভাবে মনে নেই, তবে সম্ভবত এর মধ্যে রয়েছে কিছু খনিজ লবণ, কিছু ভিটামিন, পানি ইত্যাদি।

– ঠিক বলেছ। তাহলে আমাকে বলো, এর মধ্যে যে সুতো টা দেখতে পাচ্ছ, সেটা কী?

দুই বন্ধু চুপচাপ বসে রইল।

– নিশ্চয়ই তোমরা ভাবছো যে এটা আমার যাদুর ভেলকিবাজি। ঠিকই ভেবেছো। কিন্তু কিছুই জানো নি। আমাদের এমন অনেক ভাবনা রয়েছে যা আমাদেরকে জ্ঞান দান করে না। আমাদের অনেক জ্ঞান রয়েছে যা আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে না। তাহলে দেখো, আমি সুতো টা ধরে টান দিচ্ছি।

তিনি সুতোটা ধরে টান দিতেই ফলটি পচে গলে এলিয়ে পড়ল।

– হাত দিয়ে দেখো।

তারা দুই বন্ধু কাঁচের পাত্রের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে স্পর্শ করে আঙ্গুল বাইরে এনে দেখল যে ফলটি পচে গেছে এবং তা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

এবার গুরুজী আরো একটি কাচের পাত্র এনে তার মধ্যে সবজির পাতাগুলি ছেড়ে দিলেন। দেখা গেল যে তার মধ্যেও একটি সুতোর মতো কী যেনো বস্তু রয়েছে। গুরুজী জিজ্ঞাসা করলেন – এই সবজির মধ্যে কী কী উপাদান রয়েছে তা তোমরা ভালোভাবেই জানো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছ যে এর মধ্যেও একটা সুতো রয়েছে। তাহলে দেখা যাক। আমি পাতা গুলোর মধ্য থেকে সুতো টা টেনে বের করে ফেলি।

দেখা গেল যে সূতো টা টেনে বের করার সাথে সাথেই পাতাগুলি পচে গলে গেল।

এভাবে জীবন্ত নতুন পোকাটিকেও কাঁচের বাক্সের মধ্যে রাখা হলো। তার মধ্যেও একটি সূতো রয়েছে বলে দৃশ্যমান হলো। গুরুজী সুতোটা টান দিতেই পোকাটি পচে গলে গেল।

– এ কিভাবে সম্ভব? এবং কোন কারণে সব ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটল? আমরা বিনীতভাবে জানতে চাই, গুরুজী।

গুরুজী বললেন – প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই বিভিন্ন উপাদানের সাথে একটি উপাদান রয়েছে। এই সূতোটাকে পৃথিবীর প্রত্যেকটা উপাদান থেকে টেনে বের করে নিলে সঙ্গে সঙ্গে তা ধ্বংস হয়ে যাবে বা অস্তিত্ব হারাবে।

বুড্ডা জিজ্ঞাসা করল – এ কিন্তু আগে কখনো শুনিনি, গুরুজী?

– শুনেছো, তবে আমি যেভাবে বলছি সেভাবে শোনো নি। এবং আমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে যে বিষয়টি দেখাতে চাচ্ছি সেভাবে তা কখনো দেখনি। তাই যা দেখেছ তা থেকে জ্ঞান সৃষ্টি হয়নি। যদি কোনো জ্ঞান অর্জিত হয়েও থাকে, তবুও যা জেনেছ তার অদৃশ্য মাত্রা সম্পর্কে কিছু জানতে পারোনি। সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে এক বা একাধিক উপাদান রয়েছে, এবং সেই সব উপাদানের সাথে রয়েছে এমন একটি উপাদান যা সব বস্তুর মধ্যেই রয়েছে। এই উপাদানটি অদৃশ্য। আমরা জানি যে বস্তুর মধ্যে রয়েছে এনার্জি বা শক্তি। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণটা এই সত্যটাকেই প্রমাণ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা এই কথাটার পিছনে যে আরো একটি রহস্য রয়েছে তা ভেবে দেখি না। একেবারেই যে ভাবি না তা বলছি না, বরং আমি বলছি যে, সেই বিষয়টাকে আমরা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভেবে দেখি না। দৈনন্দিন অর্থে হয়তোবা ভাবি। আর তাই তা থেকে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারি না।

বুড্ডা বলল – গুরুজী, আর দেরী সইছে না।

সোহাগ বলল – গুরুজী, বুড্ডার চেয়ে আমার দাবি আগে, কারণ আমি ওকে আপনার কাছে টেনে এনেছি।

গুরুজি বললেন – প্রত্যেকটা বস্তুর মধ্যে একটা সুতো রয়েছে।

বুড্ডা জিজ্ঞাসা করল – এই সূতোটা কী, গুরুজী?

গুরুজী বললেন – সোহাগ, তুমিও একই প্রশ্নটা করো।

সোহাগ প্রশ্ন করল – এই সূতোটা কী, গুরুজী?

গুরুজী বললেন – এই সুতোটা হলো সময়

দুই বন্ধু চোখ বড় করে গুরুজীর দিকে তাকিয়ে রইল।

গুরুজী বললেন – সময়ের তীর বরাবর বা সময়ের স্কেল বরাবর সবকিছু তার পরিণতির দিকে ছুটে যায় – এভাবেই আমরা বাস্তবতার পিছনে লুকানো সময়কে চিহ্নিত করতে শিখেছি। আর তাই আমরা যা শিখেছি তা কখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন “আজানুম মুসাম্মা”, অর্থাৎ সময়কে স্থাপন করেছি। অর্থাৎ তিনি প্রতিটি বিষয় কে সৃষ্টি করে তার জন্য নিজস্ব একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি প্রতিটি জিনিস সৃষ্টির সময়ে তার মধ্যে তার নিজস্ব সময় কে স্থাপন করেছেন। এই সময়কে যদি যে কোনো বস্তু থেকে তুলে নেয়া হয়, তাহলে তার মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য উপাদান আর পরস্পর সহাবস্থানে থাকতে পারে না, বরং অণু-পরমাণুতে বিভাজিত হয়ে বস্তুর সার্বিক বৈশিষ্ট্য ধারণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

বুড্ডা মন্তব্য করল – গুরুজী, সময় সম্পর্কে ইদানিং থিওরি অফ রিলেটিভিটির আলোকে বৈপ্লবিক ভাবে ভিন্ন একটা কায়দায় সবাই চিন্তা করে। কিন্তু ধরে নেয়া হয় যে, মহাবিশ্বে সময়ের তীর বলে কিছু একটা আছে এবং তার মধ্যে ব্যক্তি কতটা গতিশীল অবস্থায় রয়েছে তা অনুযায়ী তার নিজস্ব অনুভূতিতে সময় কেমন তা নির্ভর করবে।

– কিন্তু আমার মনে হয় আপনি এতক্ষণ যা বললেন তার তাৎপর্য থিওরি অফ রিলেটিভিটির তাৎপর্য থেকেও একেবারে ভিন্ন কিছু – সোহাগ মন্তব্য করল। আপনি সময়কে বস্তুর উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সময়কে বস্তুর মধ্যেই নিহিত আছে বলে বর্ণনা করছেন। অথচ এমনকি, আমার জানামতে, আধ্যাত্বিক অর্থে যারা পণ্ডিত রয়েছেন, তারা সময়কে তুরীয় বা অণুভেদী বা ট্রানসেন্ডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেন। আপনার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি টা যদি একটু বিশ্লেষণ করতেন তাহলে তা বোঝার চেষ্টা করে হয়তো কিছুটা সফল হতাম।

গুরুজি বললেন – আমি যা বলেছি তা কিন্তু আমার কথা নয়। আল্লাহ নিজেই তো বলেছেন যে তিনি সবকিছু কে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তার অর্থ এই যে, প্রতিটি সৃষ্টির এককের মধ্যে তার জৈবিক বা অ-জৈবিক উপাদান এর সাথে ‘সময়’ নামক একটি মহাজাগতিক উপাদান প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে…

– ফলে? – অপেক্ষায় রইল বুড্ডা।

গুরুজী বললেন – ফলে প্রতিটি বস্তুর সময় সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অস্তিত্বের মানচিত্রের সাথে জড়িত। অর্থাৎ আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সময় তার একান্তই নিজস্ব। আইনস্টাইন যা বলেছেন তার অর্থ কিন্তু এটাই দাঁড়ায়। সময় আপেক্ষিক। অর্থাৎ ব্যক্তি তার অবস্থা ও অবস্থান অনুযায়ী তার সময়কে অনুভব করবে। তার মানে হলো, প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব সময়ের সুতো রয়েছে। সেই সুতো প্রতিনিয়ত কমছে। অবশ্য আলোর গতিতে চলতে পারলে আইনস্টাইনের অভিমত অনুযায়ী যেহেতু তা বেড়ে যায় সেহেতু এরূপ ক্ষেত্রে তা বেশি লম্বা হয়ে যায়। পদার্থবিদ্যায় সময়ের যে তীর এর কথা বলা হয় তা মূলত মহাবিশ্বকে একটিমাত্র সমন্বিত সিস্টেম হিসেবে ধরে নিলে সেই সিস্টেমকে একটি শারীরিকভাবে অস্তিত্বশীল একক হিসেবে ভাবা যায়। সেই অর্থে সেই সিস্টেম নিজেই সৃষ্টির একটি একক। ব্যক্তির জন্য এই সময় হলো ট্রানসেনডেন্ট। আবার, প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব সময়ের তীর ও রয়েছে।

বুড্ডা প্রশ্ন করল – তাহলে মুহূর্তের মধ্যে এতো দীর্ঘকালের ঘটনাবহুল মিরাজ কিভাবে সংঘটিত হলো? পৃথিবীর কেউ তা জানতে পারল না।

গুরুজী বললেন – জবাব তো আমি দিয়েই দিয়েছি। আল্লাহর রসূল (স) মেরাজের ক্ষেত্রে কেবল তাঁর নিজস্ব সময়কে ব্যবহার করেছেন। অন্য কোনো ব্যক্তির বা এমনকি সৃষ্টিজগতের সময়ের তীর তার এই ভ্রমণের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। কারণ সময় একটি পূর্ণাঙ্গ ভাবে নিজস্ব ব্যাপার। আমাদের নৈমিত্তিক জগতের গতি দ্বারা প্রভাবিত অনুভূতিতে জগতের স্বাভাবিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য সময় বলে আমরা যাকে চিহ্নিত করি, তা কেবল তখনই অর্থ পায়, যখন আমরা সবাই একই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তা নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়ে দিয়েছেন যে আমাদের এই ঐকমত্য পূর্ণ সমাজের যেকোনো একজনও যদি তার গতি এবং অবস্থান পরিবর্তন করে, তাহলে সে তার নিজস্ব সময়কে উপলব্ধি করবে। বলে সর্বজনস্বীকৃত এই সময় তার অনুভূতিতে অর্থপূর্ণ হবে না। সময় একেবারেই একটা নিজস্ব ব্যাপার। তোমার দৃষ্টিতে তুমি আল্লাহর রসুলের (স) সময়ের তীরটাকে একদম দেখতে পাচ্ছো না। তার সমসাময়িক যারা ছিলেন, তারা নিজের তীরের ওপর দিয়ে সামনের দিকে চলছিলেন। ফলে তারাও রসূলের (স) তীর সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেননি। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তা ঘটেছিল এবং যে পরিবেশে ঘটনার যে চিত্র হবার কথা ছিল সে ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। আমরা যেমন স্বাভাবিক ভাবে চলি ফিরি, খাই-দাই, তিনি তাঁর সেই ভ্রমণে তেমনি স্বাভাবিকভাবেই গতিশীল এবং কর্ম ব্যস্ত ছিলেন তাঁর নিজস্ব সময়ে। যাবতীয় ঘটনা তাঁর কাছে তাঁর অনুভূতিতে স্বাভাবিক ছিল।

সোহাগ প্রশ্ন করল – আমি বিস্মিত, গুরুজী। তবে জানতে ইচ্ছে করছে আইনস্টাইনের থিওরি অফ স্পেশাল রিলেটিভিটি কে আপনি আপনার তথ্যের সাথে কিভাবে মেলাবেন।

গুরুজী বললেন – তাহলে এসো আলো এবং তার গতির সম্পর্কে কথা বলা যাক। এই তত্ত্বে আইনস্টাইনের চিন্তার যে সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীগণ আপ্লুত। কিন্তু এই তথ্যের পিছনে আরো যে রহস্য লুকিয়ে আছে তা আইনস্টাইন নিজেও জানতেন না।

(চলবে)

মন্তব্য লিখুন

একই বিভাগে আরও

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

আল-কোরআনের অজানা রহস্য – ২

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১

ভালোবাসার শানে নুজুল

আরও পড়ুন

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

ফেব্রুয়ারি ২৭ ২০২৪

Instant Writing Techniques 1

ফেব্রুয়ারি ২২ ২০২৪

আল-কোরআনের অজানা রহস্য – ২

ফেব্রুয়ারি ১৫ ২০২৪

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১