সময়ের অজানা রহস্যঃ বিজ্ঞানের ওপারে – ১

বড় করুন

ছোট করুন

সোহাগ দৌড়ে বুড্ডার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো – বুড্ডা, একটা ঝামেলা হয়েছে। আজ আমাকে একজন বলল যে আল্লাহর রাসূল (স) মেরাজের রাতে আল্লাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য আরশে যাননি।

বুড্ডা বলল – তার মানে, সেই ব্যক্তি অস্বীকার করছে যে আল্লাহর রসূল (স) আরশে গিয়েছেন।

সোহাগ বলল – সে বলছে যে রসূল (স) সশরীরে আরশে যাননি। তার মানে তো এই যে, সে বলতে চাচ্ছে যে, তিনি আরশে যাননি। আমারও তো সেই একই মন্তব্য। তিনি সশরীরে আরশে যাননি – এই কথা বলা মানে হলো তাঁর আরশে যাওয়ার ঘটনাটি অস্বীকার করা। অথচ সে বলতে চাচ্ছে যে রসূল (স) আরশে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি সশরীরে যাননি।

বুড্ডা বলল – তাহলে কি আল্লাহ নিজেই তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন? কথাটার অর্থ কী দাঁড়ায়?

সোহাগ বলল – আমি জানি না। আমার মনে হয় যে সশরীরে আরশে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করা মানে হলো মিরাজকে পুরোপুরি অস্বীকার করা। এ ব্যাপারে তোমার কি মন্তব্য?

বুড্ডা বলল – আমি স্বল্প জ্ঞানের শিক্ষার্থী। এ ব্যাপারে যা পড়েছি এবং যা বিশ্বাস করা উচিত বলে মনে করেছি তা বিশ্বাস করে নিয়েছি। এই রহস্যময় বিষয়টা বুদ্ধি দিয়ে অনুভব করার ক্ষেত্রে অাসম্ভাব্যতা থাকতে পারে বলেই তা বিশ্বাস করে নিয়েছি। যুক্তি বিশ্লেষণের অতীত একটা ঘটনা এখানে আল্লাহ নিজেই ঘটিয়েছেন। কিন্তু ঘটনাটা স্বয়ং আল্লাহ নিজেই ঘটিয়েছেন বলে, এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিত্বে বিশ্বাস করতে হয় বলে, তা বিশ্বাস করে নিয়েছি। আর তাই এ ব্যাপারে নতুন কোনো প্রশ্ন জাগে নি।

সোহাগ বলল – আল্লাহর রসূল (স) নিজেই বলেছেন যে তিনি আরশে গিয়েছেন। তাঁর মুখের এই কথা শুনে যদি গোটা পরিস্থিতি এবং ঘটনা বিশ্লেষণ করতে শুরু করা হয়, এবং অবিশ্বাস্যতার জায়গাগুলোতে চিন্তার অভিযান চালিয়ে যদি দেখা যায় যে আমার চিন্তা ও জ্ঞান অনুযায়ী ঘটনাটা ঘটা অসম্ভব, এবং সেই অনুযায়ী আমি যদি এই বিশ্বাস পোষণ করি যে আল্লাহর রাসূল যা বলেছেন তা সত্য হলেও তিনি সেই ভ্রমণের বিষয়ে যা মনে করেছেন বা উপলব্ধি করেছেন তা সত্য নয়, অর্থাত তিনি মানসিক ভ্রমণকে শারীরিক ভ্রমণ হিসেবে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন, তাহলে তো মিরাজকে বিশ্বাসস করেও আল্লাহর রাসূলের কথাই অবিশ্বাস করা হলো। পুরোপুরি অবিশ্বাস করা কুফরী। কিন্তু নিজের ব্যাখ্যার সঙ্গে কোনো কিছু মেলানো যাচ্ছে না বলে আমি যদি বলি যে তিনি আধ্যাত্মিক ভাবেই সেখানে গিয়েছিলেন কিন্তু বিভিন্ন অনুভূতি ও উপলব্ধির কারণে তার কাছে মনে হয়েছে যে তিনি সেখানে সশরীরে গিয়েছিলেন, তাহলে কি আমি আল্লাহর রাসূলকে মিথ্যাবাদী না বললেও অযোগ্য এবং পরিস্থিতি উপলব্ধির ক্ষেত্রে অক্ষম ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য করছি না? আমি কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি যে তিনি আত্মিকভাবে এক মুহূর্তের মধ্যে এই ভ্রমণ করেছেন, কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছে যে তিনি শারীরিকভাবে ভ্রমণটা করেছেন। যারা এই জাতীয় কথা বলে, তারা কি আল্লাহর রাসূলকে মানসিকভাবে এবং উপলব্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে অযোগ্য হিসেবেই তুলে ধরে না? তারা তো মেরাজকে অাংশিকভাবে স্বীকার করলেও স্বয়ং রসূলকেই অবিশ্বাস করছে। এর চেয়ে তো ঘটনাটা পুরোপুরি অবিশ্বাস করাই ভালো, কারণ যে ঘটনাটা অবিশ্বাস করছে, সে হয়তো একদিন তা বিশ্বাস করার সুযোগ পাবে, কিন্তু যে ব্যক্তি এই দাবী করছে যে ঘটনাটা মানসিকভাবে ঘটেছিল কিন্তু ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে রসূল (স) নিজেই ভুল করে ফেলেছেন, সে তো রিসালাত কে স্বীকৃতি দিয়েও আল্লাহর ক্ষমতার এবং রসূলর যোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছে। একদিকে সে রসুলের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, এবং অন্যদিকে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে পুরো ব্যাপারটার সাথে একটা ত্রুটি বা ভুল জড়িত – উপলব্ধির ভুল, এবং আল্লাহ তাঁর রসূলের মানসিক শক্তির ব্যাপারে কোনো কিছু না জেনে তাঁকে মেরাজে নিয়ে গেছেন। যারা সশরীরে যে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল এই কথা অস্বীকার করে, তারা মূলত এই ধারণাগুলো পোষণ করে। কিন্তু এই বিষয়গুলো আমি বুঝতে পারা সত্ত্বেও আমি যখন অন্যের কাছে বিষয়টার প্রতি নিজের মনোভাব তুলে ধরতে যাই, তখন শুধু বিশ্বাসের ওপর আমাকে ভর করতে হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে যারা ভুল মন্তব্য করছে, তাদেরকে বোঝাবার মতো কোনো জ্ঞানভিত্তিক ভাষা আমি খুঁজে পাই না। আর এ কারণেই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে তোমার সামনে এসে হাঁপাতে শুরু করেছি। আমার নিঃশ্বাসে ঘাটতি পড়ছে। তুমি এই ব্যাপারে কিছু বল।

বুড্ডা বলল – আমি স্বল্প জ্ঞানের মানুষ। বরং চল, আমরা জ্ঞানগুরুর কাছে যাই।

– কিন্তু তিনি তো শিক্ষা-দেয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। তার শিক্ষা কেউ গ্রহণ করে না বলে তিনি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। তাকে তো এখন পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

বুড্ডা বলল – আমরা তাকে সেখানেই খুঁজে নেব যেখানে তিনি রয়েছেন।

তারা দুই বন্ধু গুরুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে জঙ্গলে গাছের পরিচর্যায় রত অবস্থায় পাওয়া গেল।

তিনি কোনোভাবেই জ্ঞানের আলোচনায় প্রবেশ করতে চাননি। তার অভিযোগ, পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞান-বিমুখ জাতি হলো মুসলিম জাতি। তাদেরকে মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানের আধার কোরঅান গ্রন্থ টা দেয়া হয়েছে, অথচ তারা জ্ঞানের কদর নিজেরাই বোঝে না।

তবুও দীর্ঘদিনের সম্পর্কের দাবি নিয়ে এই দুই বন্ধু এমনভাবে গুরুজীকে ধরল যে তিনি সেই জঙ্গলে বসেই তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন।

গুরুজী বললেনঃ

আমরা বিশেষ করে মিরাজের প্রসঙ্গে কথা বলব। এবং সেই প্রসঙ্গে সময় যেহেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, সেহেতু সেই আলোচনার সূত্র ধরে সময় সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করব।

আল্লাহর রসূল সশরীরে আরশে গিয়েছিলেন না কি অাত্মিকভাবে? – এই প্রশ্ন প্রায় দেড় হাজার বছর ধরেই উচ্চারিত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানের আলোকে সংশ্লিষ্ট বাস্তবতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেউ কেউ এই বিষয়টি স্বীকার করতে চাচ্ছেন যে তিনি সশরীরে আরশে গিয়েছিলেন এবং তা তত্ত্বীয়ভাবে সম্ভব, বাস্তবে না হলেও। তবে তারা তা প্রমাণ করতে পারছেন না। আবার, কেউ কেউ বলছেন যে সময় গতি ও ভ্রমণের সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, তিনি আধ্যাত্বিক ভাবেই আরশে গিয়েছিলেন।

আবার কেউ কেউ বিজ্ঞানের আলোকে সমর্থন দেয়ার কিংবা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে মেরাজের রাতে মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ কোটি মাইল পথ পার হয়ে সেখানে প্রায় দুই যুগ সময় অবস্থান করার পর আবার ও পৃথিবীতে ফিরে এসে এই যে বিস্ময়কর বিষয়টি দেখা গেল যে এক সেকেন্ড সময়ও যাবতীয় কাজের জন্য ব্যয় হয়নি, তা গ্রহণযোগ্য, কারণ আইনস্টাইন সময় সম্পর্কে আমাদেরকে এমন একটি ভিন্ন ধারণা দিয়েছেন, যা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, সময় আপেক্ষিক, এবং আলোর বেগে গতিশীল হতে পারলে সময় এর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা যায়, বা তার পিছনেও যাওয়া যায়।

অবশ্য বিজ্ঞান যদি চূড়ান্তভাবে এই বিষয়টি সমর্থন করতো তাহলে বিজ্ঞান-জানা ব্যক্তিগণ নির্দ্বিধায় মেরাজের ঘটনা স্বীকার করে নিতেন। কিন্তু বিজ্ঞানের নতুন তথ্য ও তত্ত্বাবলী মিরাজের সাথে সংশ্লিষ্ট অভাবনীয় চিন্তা ধারাকে সমর্থন করলেও, এখনো পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি। তাই কেউ বিজ্ঞানের আলোকে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করলেই অনায়াসে তার বিরুদ্ধেও যুক্তি দেখানো যায়, বা যারা যুক্তি দেখাতে চান তারা তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে দেরি করেন না।

যারা কোনোরূপ যুক্তিতর্ক ছাড়াই বিষয়টি গ্রহণ করেন বা বিশ্বাস করেন তারা তো আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নন, কারণ বিশ্বাস করলে তো সে ক্ষেত্রে যুক্তি দেখাবার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না।

এখন তোমরা আমাকে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে বলছো। আমি নিজে যেহেতু বিষয়টি বিশ্বাস করি, সেহেতু আমার বিশ্বাসকে উপস্থাপন করার জন্য আমি কোনো যুক্তি দেখাবো না বা তোমরা আমার কাছ থেকে তা দাবিও করবে না। যারা তা বিশ্বাস করতে পারছে না, তাদেরকে বিশ্বাস করার কাজে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে আমাকে যদি বিজ্ঞানের তথ্য ও তত্ত্ব উপস্থাপন করতে বলো, তাহলেও আমি বলব যে, বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলি আমার চেয়ে বেশি জানেন যারা, তারাই বিজ্ঞান এর মাধ্যমে বিষয়গুলি ব্যাখ্যাযোগ্য হলে নিজেরাই তার ব্যাখ্যা দিতেন।

যারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহর রসূল (স) আরশে গিয়েছিলেন, কিন্তু তা বিশ্বাস করার পরেও, এক সেকেন্ডের মধ্যে এতকিছু কিভাবে ঘটে গেল তা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা না পেয়ে যখন মিরাজকে সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করে এবং বলে যে মিরাজ সংঘটিত হলেও তা ঘটেছিল আধ্যাত্বিক অর্থে, কারণ শারীরিক অর্থে বস্তুজগতের নিয়ম-নীতি সীমাবদ্ধতার আলোকে মিরাজের সম্ভাব্যতা গ্রহণযোগ্য নয়, তাদের সম্পর্কেই তোমরা আমাকে কথা বলতে বলছো।

তোমাদের বিষয় নির্বাচন সঠিক হয়েছে।

যারা মিরাজকে স্বীকার করলো, কিন্তু সেখানেও নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রয়োগের ফলে মনে করলো যে বাস্তবতার নিরিখে তা সম্ভব নয়, এবং ফলে সে ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার ছত্রছায়ায় মিরাজকে স্রেফ একটি মানসিক ক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করলো, তাদের জন্যেই আলোচনা প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং যারা মিরাজকে স্বীকার করেও আল্লাহর রাসূলকে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মিথ্যাবাদী মনে করলো, তাদের বিশ্বাসের ত্রুটির ব্যাপারে আমি আমার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে চাই।

আমি জানি যে তোমরা সব সময়ে আমার কাছে নতুন কিছু আশা করো। তোমরা বিশ্বাস করো যে জ্ঞানের যে শাখাতেই তোমাদের কিছু প্রশ্ন থাকে সেখানে ই আমি এমন জবাব দিয়ে থাকি যা পৃথিবীতে আর কেউ দেয়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমার কাছে নতুন কোনো জ্ঞান রয়েছে বলে আমার মনে হয় না। বরং আমার মনে হয় যে আমি সবকিছু নতুন করে বলার চেষ্টা করি। আর তাতেই তোমরা মুগ্ধ হও। সুতরাং আজও তোমাদেরকে বঞ্চিত করার ইচ্ছে নেই। আজ তোমাদেরকে এমন কিছু কথা বলব যা পৃথিবীর কেউ কখনো শোনেনি। অথচ তোমরা বুঝতে পারবে যে কথাগুলো সত্য।

(চলবে)

মন্তব্য লিখুন

একই বিভাগে আরও

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

আল-কোরআনের অজানা রহস্য – ২

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১

ভালোবাসার শানে নুজুল

আরও পড়ুন

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ২

ফেব্রুয়ারি ২৯ ২০২৪

আত্মজ্ঞানের ভূমিকা – ১

ফেব্রুয়ারি ২৭ ২০২৪

Instant Writing Techniques 1

ফেব্রুয়ারি ২২ ২০২৪

আল-কোরআনের অজানা রহস্য – ২

ফেব্রুয়ারি ১৫ ২০২৪

আল-কুরআন এর অজানা রহস্য – ১